বন্যা কী? বন্যা সৃষ্টির কারন এবং বন্যার ফলাফল ও বন্যার পরবর্তী ব্যাবস্থাপনা সমন্ধে নিচে সংক্ষেপে আলোচনা করা হলো।
বন্যা কোনো ভূভাগ বেশ কয়েকদিনের জন্য বিশাল জলরাশির দ্বারা আবৃত হয়ে পড়ার অবস্থাকে বন্যা বলে।
নদী খাতের নির্দিষ্ট প্রবাহ ক্ষমতা থাকে। নদী অববাহিকায় অতিবৃষ্টি অথবা অন্য কোনো উৎস থেকে প্রচুর পরিমাণে জল চলে এলে নদী তা বহন করতে পারে না। ফলে নদিখাতের জল তীরের দিকে প্রসারিত হয়ে বন্যা ঘটায়।
প্রতি বছর পৃথিবীতে বন্যার ফলে প্রায় ২০,০০০ লোকের মৃত্যু হয় এবং ২ কোটি মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এশিয়া মহাদেশে বন্যায় ক্ষয়ক্ষতি হয় সবথেকে বেশি। বন্যার জলে ডুবে মানুষের যেমন মৃত্যু হয়, তেমনই সাপের কামড়,ম্যালেরিয়া, আন্ত্রিক, টাই ফয়েড প্রভৃতির জন্য মানুষের মৃত্যু হয়।
বন্যা সৃষ্টির কারণ:
বন্যা সৃষ্টির পিছনে একাধিক প্রাকৃতিক ও মনুষ্যসৃষ্ট কারণ রয়েছে। যথা –
প্রাকৃতিক কারণ:
১) দীর্ঘ স্থায়ী প্রবল বৃষ্টি:
অধিক সময় ধরে প্রবল বৃষ্টি হলে নদী, খাল – বিলগুলির ধারণ ক্ষমতার তুলনায় জল অনেক বেড়ে যায়, ফলে বন্যার সৃষ্টি হয়।
উদাহরণ – ক) অধিক বৃষ্টিপাতের কারণে 1978 সালে দামোদর নদের বন্যায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছি ল। খ) 2013 সালের cloud burst বা মেঘ ভাঙা বৃষ্টির ফলে উত্তরাখণ্ডের কেদারনাথ এ বন্যা হয়েছিলো।
২) হিমবাহের গলন:
গ্রীষ্মকালে অধিক উষ্ণতার কারণে হিমবাহ গলন এর পরিমান বৃদ্ধি পায়। ফলে, হিমবাহ থেকে সৃষ্ট নদীগুলোতে জলের পরিমাণ বৃদ্ধি পায় ও বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়।
৩) অগভীর নদী উপত্যকা:-
দীর্ঘ দিন পলি জমে নদী উপত্যকা অগভীর হয়ে পড়লে বর্ষায় নদীর জল স্বাভাবিকভাবেই দুকূল ছাপিয়ে বন্যার সৃষ্টি করে।
উদাহরণ – গঙ্গা নদীতে এ কারণে প্রায়শই বন্যা হয়।
৪) ঘূর্ণিঝড়:
প্রবল ঘূর্ণিঝড়ে সমুদ্রে জলোচ্ছ্বাস হলে উপকূল অঞ্চল প্লাবিত হয়।
উদাহরণ – 2009 সালে “আয়লা” ঝড়ের প্রভাবে সুন্দরবন অঞ্চলে বন্যা সৃষ্টি হয়। 2015 সালের শক্তিশালী ক্রান্তীয় ঘুর্ণবাতের কারণে তামিলনাড়ুর বন্যা উল্লেখযোগ্য ঘটনা।
৫) সুনামি:-
সুনামির জলোচ্ছ্বাসে উপকূলবর্তী অঞ্চলে বন্যা দেখা দেয়।
উদাহরণ – 2004 সালে তামিলনাড়ু উপকূলের সুনামির ফলে সৃষ্ট বন্যা।
৬) জোয়ার:
সাধারণত বর্ষার সময় নদীতে ভরা জোয়ার এলে অনেক সময় বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়।
মনুষ্যসৃষ্ট কারণ:
১) বৃক্ষ ছেদন:
নির্বিচারে গাছ কাটার ফলে মৃত্তিকা ক্ষয় বৃদ্ধি পায়। এই মৃত্তিকা নদীগর্ভে সঞ্চিত হয়ে নদীর জলধারণ ক্ষমতা কমিয়ে দেয়। ফলে, নদীতে জলের পরিমাণ বাড়লে বন্যা সৃষ্টি হয়।
২) বাঁধের জল ছাড়া:
বর্ষাকালে নদীতে বাঁধের পিছনে জলের পরিমাণ বিপদসীমা অতিক্রম করলে বাঁধের জল ছাড়তে হয়। এর ফলে বিস্তীর্ণ অঞ্চল প্লাবিত হয়।
উদাহরণ – DVC, কংসাবতী,ময়ূরাক্ষী জলাধারের জল মাত্রাতিরিক্ত ছাড়ার ফলে পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণবঙ্গের জেলাগুলিতে প্রায় বন্যা দেখা দেয়।
৩) নদী প্রণালীর পরিবর্তন:
জলবিদ্যুৎ উৎপাদন এবং জল সেচের কারণে নদীপথে বাঁধ এবং জলাধার নির্মাণের ফলে নদী প্রণালীর যে পরিবর্তন ঘটে তাতে নিম্ন অববাহিকায় বন্যার সম্ভাবনা বৃদ্ধি পায়।
৪) নগরায়ণ:
অতীতকাল থেকে নদীকে কেন্দ্র করেই নগর সভ্যতার বিকাশ ঘটেছে। আধুনিক সভ্যতায় নগরায়ণ ও শিল্পায়ন অধিক ঘটায় নদী অববাহিকার মাটিতে জলের অনুপ্রবেশ হ্রাস পেয়ে পৃষ্ঠ প্রবাহ বৃদ্ধি পেয়েছে, যার ফলে বন্যার প্রবণতা অনেক বেড়েছে।
আরও পড়ুন/ Important links
ভূমিকম্প কাকে বলে? ভূমিকম্পের কারণ ও ফলাফল গুলি আলোচনা করো। Earthquake Causes and it’s effect
ওয়েগনার এর মহাদেশীয় সঞ্চালন তত্ত্বের সপক্ষে প্রমাণ গুলি বর্ণনা কর।
Q. বন্যার ফলে সৃষ্ট বিপর্যয় গুলি উল্লেখ করো।
বন্যার ফলে সৃষ্ট বিপর্যয়:
১) খাদ্যাভাব:
বন্যার ফলে মাঠের ফসল ( ধান,গম প্রভৃতি ) জলে ডুবে নষ্ট হওয়ায় মানুষ ও পশুর খাদ্যের অভাব হয়।
২) পশু মৃত্যু:
বহু বন্য ও গৃহপালিত জীবজন্তু বন্যার জলে ভেসে যায় ও মারা যায়।
৩) সম্পত্তিহানি:
মানুষের ঘরবাড়ি,সম্পদ বন্যার জলে ভেসে মানুষ নিঃস্ব হয়ে পড়ে।
৪) জীবনহানি:
বন্যার জলে ডুবে এবং বন্যা পরবর্তী নানান ধরনের রোগে বহু মানুষের জীবনহানি ঘটে।
বিপর্যস্ত যোগাযোগ ব্যবস্থা:- যোগাযোগ ব্যবস্থা(রাস্তাঘাট,রেলপথ), বৈদ্যুতিক ব্যবস্থা জলমগ্ন হয়ে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে।
৬) জলদুষণ :
জীবজন্তুর দেহাবশেষ পচে ও নানা বর্জ্য পদার্থ মিশে বন্যার জল চরমভাবে দূষিত হয়।
৭) মহামারী:
ডায়ারিয়া, ভাইরাস সংক্রমণ ও ম্যালেরিয়ার মতো মহামারী দেখা দেয়।
৮) জলসংকট:
বন্যার ফলে নলকূপের জল দূষিত হয় এবং পানীয় জলের তীব্র সংকট দেখা দেয়।
৯) মাটির লবনতা বৃদ্ধি:
সমুদ্রের লবণাক্ত জল দ্বারা প্লাবিত অঞ্চলের মাটি লবণাক্ত হয়ে পড়ে।
১০) মৎস্যজীবীদের ক্ষতি:
উপকূল এলাকায় মাছ ধরার সরঞ্জাম ও নৌকো হারিয়ে যায়।
বন্যার ভিডিও দেখার জন্য ক্লিক করুন 👇
Q.বন্যার হাত থেকে মুক্তি পেতে গৃহীত ব্যবস্থাপনা গুলি আলোচনা কর।
১) সতর্ক বার্তা:
বিভিন্ন গণমাধ্যম যথা – রেডিও,টিভি প্রভৃতির মাধ্যমে বন্যার পূর্বেই বারবার জনগনকে সতর্ক করা প্রয়োজন।
২) অঞ্চল চিহ্নিতকরণ:
বন্যা প্রবণ অঞ্চল গুলিকে চিহ্নিত করে ওই অঞ্চলে নিরাপদ দুরত্বে বন্যার হাত থেকে বাঁচার উপযুক্ত বড়ো বাড়ি তৈরি করা প্রয়োজন।
৩) নাব্যতা সৃষ্টি:
বন্যা প্রবণ অঞ্চলের নদীগুলির নাব্যতা বজায় রাখা প্রয়োজন।
৪) বাঁধ নির্মাণ:
বন্যপ্রবন অঞ্চলে প্রয়োজনে বিজ্ঞান সম্মতভাবে নদীতে বাঁধ দেওয়া এবং সঠিক সময়ে মেরামত করা প্রয়োজন।
৫) অন্যান্য প্রয়োজনীয় বিষয়:
বন্যা কবলিত মানুষের জন্য পানীয় জল, ওষুধ ও খাদ্যের জোগান রাখা প্রয়োজন।
“বন্যা কী? বন্যা সৃষ্টির কারণ এবং বন্যার ফলাফল ও বন্যা পরবর্তী ব্যাবস্থাপনা |”-এ 1-টি মন্তব্য