জোয়ার ভাটা কাকে বলে? চিত্রসহ জোয়ারভাটা সৃষ্টির কারণ ও ফলাফল আলোচনা কর| High and low tide, It’s causes and effects

 জোয়ারভাটা সংজ্ঞা:

প্রতিদিন নিয়মিত ভাবে নির্দিষ্ট সময় অন্তর পৃথিবীর সাগর, মহাসাগরের জলরাশির কোনো স্থানে ফুলে ওঠাকে জোয়ার এবং কোনো স্থানে নীচে নেমে যাওয়াকে ভাটা বলে।

জোয়ারভাটা সৃষ্টির কারণ:

জোয়ার ভাটা সৃষ্টির কারণ নিম্নরূপ :

প্রধানত দুটি কারণে পৃথিবীতে জোয়ারভাটার সৃষ্টি হয়, যথা –

১) চাঁদ ও সূর্যের মহাকর্ষ শক্তির প্রভাব:

নিউটাউনের মহাকর্ষ সূত্রের নিয়ম অনুসারে মহাবিশ্বের প্রতিটি বস্তু পরস্পর পরস্পরকে আকর্ষণ করে।
সুতরাং, সূর্য,পৃথিবী ও চাঁদ একে অপরকে আকর্ষণ করে। চাঁদ অপেক্ষা সূর্য প্রায় 260 লক্ষ গুন ভারী । তাই চাঁদের তুলনায় সূর্যের আকর্ষণ ক্ষমতা অনেক বেশি। কিন্তু সূর্য রয়েছে পৃথিবী থেকে প্রায় 15 কোটি কিমি দূরে এবং চাঁদ রয়েছে পৃথিবী থেকে মাত্র 3 লক্ষ 84 হাজার কিমি দূরে। সূর্যের তুলনায় চাঁদ পৃথিবীর অনেক কাছে থাকায় পৃথিবীর ওপর চাঁদের মহাকর্ষ শক্তি সূর্য অপেক্ষা প্রায় 2.2 গুন বেশি কার্যকরী। এই কারণে মূলত চাঁদের আকর্ষণই জোয়ারের সৃষ্টি হয় এবং সূর্যের আকর্ষণে সৃষ্ট জোয়ার মৃদু প্রকৃতির হয়। চাঁদ ও সূর্যের মিলিত আকর্ষণে প্রবল ভরা জোয়ারের সৃষ্টি হয়।

২) পৃথিবীর কেন্দ্রাতিক বলের প্রভাব:

আবর্তন গতির ফলে সৃষ্ট কেন্দ্রাতিগ বল দ্বারা প্রতিটি অনু মহাকর্ষ শক্তির বিপরীত দিকে বিকর্সিত হয়। তবে পৃথিবীর যেদিকে চাঁদ থাকে সেদিকে কেন্দ্রাতিগ বল অপেক্ষা মহাকর্ষ বল বেশি প্রবল। কিন্তু এর ঠিক বিপরীত দিক চাঁদ থেকে অনেক দূরে থাকায় সেখানে মহাকর্ষ বল অপেক্ষা কেন্দ্রাতিগ বল বেশি প্রবল হয়। ফলে জোয়ারের সৃষ্টি হয়।
উপরোক্ত কারণে পৃথিবীর যে দুটি অংশে জোয়ারের সৃষ্টি হয় তার ঠিক সমকোণে অবস্থিত দুটি স্থান থেকে জল সরে জোয়ারের দিকে চলে যাওয়ার জলতল নেমে গিয়ে ভাটার সৃষ্টি হয়।

জোয়ার ভাটা

জোয়ারভাটার ফলাফল:

মানবজীবনে সমুদ্রতলের জোয়ার ভাটার ফলাফল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই জোয়ার ভাটার প্রত্যক্ষ প্রভাব যেমন আছে তেমনই পরোক্ষ প্রভাবও লক্ষ করা যায়।

ইতিবাচক প্রভাব:

১) নদীর নাব্যতা বৃদ্ধির ফলে নৌচলাচল এ সুবিধা:

জোয়ারের সময় নদীতে জলের পরিমাণ বেড়ে যায়। বিভিন্ন নদীর খাঁড়ির মুখ দিয়ে প্রচুর পরিমাণে জল অভ্যন্তর উপকূলে প্রবেশ করায় নদীর নাব্যতা বেশি হয় এবং নৌচলাচল এ সুবিধা হয়। জোয়ারের ফলে জলতল 8-10 মিটার পর্যন্ত উঁচু হয়।
যেমন – হুগলি নদীর মাধ্যমে কলকাতা বন্দরের জাহাজ চলাচল।

২) আবর্জনামুক্ত নদীর গতিপথ:

ভাটার টানে নদীখাত থেকে জলের সঙ্গে পলি ও আবর্জনা সমুদ্রে গিয়ে পড়ে। ফলে, নদীর জল পরিষ্কার থাকে এবং নদীখাত গভীর হয়।
যেমন – টেমস নদীর গতিপথ।

৩) বন্দরের সুবিধা:

জোয়ারের জল প্রচুর পরিমাণে নদীখাতে প্রবেশ করায়, ওই খাতের বিস্তার ও গভীরতা ও বেড়ে যায়, যা জাহাজ চলাচলে সুবিধা করে।

৪) বরফমুক্ত নদী বন্দর গঠন:

জোয়ারের লবণাক্ত জল শীতপ্রধান অঞ্চলের নদীর বন্দরগুলোতে সহজে বরফ জমতে দেয় না, বরং বরফ মুক্ত হতে ও সাহায্য করে।

৫) জলবিদ্যুৎ শক্তি উৎপাদন:

জোয়ার ভাটার শক্তিকে ব্যবহার করে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হচ্ছে।
যেমন – ভারতের করমন্ডল উপকূল, গুজরাট উপকূল, বা সুন্দরবন অঞ্চল।

৬) সামুদ্রিক মৎস্য এর সমাগমে মৎস্যজীবিদের সুবিধা:

বর্ষায় ডিম পাড়ার জন্য জোয়ারের জলের সঙ্গে বিভিন্ন সামুদ্রিক মাছ নদী মোহনায় চলে এসে সেখানে মাছের সমাগম ঘটায়, যার ফলে উপকূলের মৎস্য জীবিদের জীবিকা নির্বাহের ক্ষেত্রে সুবিধা হয়।

নেতিবাচক প্রভাব:

১) জল পানের ও জলসেচের অযোগ্য:

জোয়ারের জল নদীর স্বাদু জলকে লবণাক্ত করে তোলে, যা পান করার ও সেচ কাজ করার ক্ষেত্রে অনুপযোগী হয়ে পড়ে।

২) অগভীর নদী সৃষ্টি:

কম খরস্রোতা নদীর নদী খাতে জোয়ার ভাটা কম খেলে নদীখাতে পলির ও আবর্জনার সঞ্চয় বেশি হয়, যা নদী খাতকে অগভীর করে তোলে।
যেমন – হুগলি নদীর নদী খাত।

৩) বানডাকা :

অতি শক্তিশালী তীব্র জোয়ার উপকূলবর্তী অঞ্চলকে প্লাবিত করে, যাকে বানডাকা বলে।

৪) সম্পত্তি ও মানবীয় ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা:

উপকুলভাগ জোয়ারের জল দ্বারা প্লাবিত হলে ওই অঞ্চলের কৃষি জমিগুলি নষ্ট হয়ে প্রাণ সংশয়ের সম্ভবনা থাকে।

৫) বদ্বীপ সৃষ্টিতে বাধাদান:

পলি ও আবর্জনা মুক্ত করায় নদী মোহনায় বদ্বীপ গঠিত হয় না।

জোয়ার ভাটা সময় কালের পার্থক্য কিভাবে নদীর নাব্যতায় প্রভাব ফেলে? 

টাইগজের সাহায্যে কোনো স্থানের প্রতিদিনের জোয়ার ও ভাটার মধ্যে সময়ের পার্থক্যের লেখচিত্র আঁকা যায়।

প্রভাব:- ১) দিনে দুবার জোয়ারের জল নদী মোহনা দিয়ে প্রবেশ করায় অঞ্চলটি পলিমুক্ত হয়, যা বদ্বীপ গঠনে বাধা দেয়। ফলে নদী মোহনা সুগভীর থাকে।
২) জোয়ারের জল পলি ও আবর্জনা সহ প্রবেশ করে এবং ভাটার সময় সেগুলি বহন করে নিয়ে সাগরে ফেলে দেয়, ফলে নদীর গভীরতার সঙ্গে সঙ্গে নাব্যতা ও বজায় থাকে। ফলে জাহাজ বা নৌচলাচল এ সুবিধা হয়।

দিনে দুবার জোয়ার ও দুবার ভাটা হয় কেন?

উত্তর: পৃথিবীর একবার আবর্তন করতে সময় লাগে 24 ঘণ্টা বা 1 দিন। আবর্তন কালে পৃথিবীর যে স্থান চাঁদের সম্মুখে আসে সেখানে মুখ্য জোয়ার হয়। এর ঠিক 12 ঘণ্টা 20 মিনিট পর যে স্থানে মুখ্য জোয়ার হয়েছিল সেই স্থানটি চাঁদের বিপরীত দিকে চলে আসে। ফলে সেখানে কেন্দ্রাতিগ বলের প্রভাবে গৌণ জোয়ার হয়।
অর্থাৎ কোনো স্থানে একই দিনে একবার মুখ্য জোয়ার ও একবার গৌণ জোয়ার হয়। একই ভাবে 12 ঘণ্টা 26 মিনিট অন্তর ওই স্থানে দুবার ভাটা হয়। তাই বলা হয়, পৃথিবীর যে কোনো স্থানে দিনে দুবার জোয়ার ও দুবার ভাটা হয়।

আরও পড়ুন 👇

বন্যা কী? বন্যা সৃষ্টির কারণ এবং বন্যার ফলাফল ও বন্যা পরবর্তী ব্যাবস্থাপনা |

 “প্রতিদিন একই সময়ে জোয়ার ভাটা হয়না”- কারণ ব্যাখ্যা কর।

পৃথিবীর কোনো নির্দিষ্ট স্থানে প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময় অন্তর জোয়ার ভাটা হলেও প্রত্যহ একই সময়ে হয় না। এর কারণ –
১) পৃথিবী নিজ অক্ষের চারদিকে পশ্চিম থেকে পূর্বে 24 ঘণ্টায় একবার আবর্তন করে।
২) চাঁদ নিজ কক্ষে পৃথিবীর চারদিকে পশ্চিম থেকে পূর্বে 27 পূর্ণ 1/3 দিনে একবার পরিক্রমন করে।
সুতরাং, পৃথিবীর যে অংশটি চাঁদের সম্মুখে রয়েছে, 24 ঘণ্টা পর 360° আবর্তন করে সেই অংশটি আবার পূর্বের অবস্থানে ফিরে আসে। কিন্তু, ওই সময়ের মধ্যে চাঁদ তার কক্ষপথে প্রায় 13°10′ কৌণিক দূরত্ব অতিক্রম করে। ফলে, ওই অংশটিকে পুনরায় চাঁদের সম্মুখীন হওয়ার জন্য আরো 13°10′ পথ অতিক্রম করতে হয়। এর জন্য সময় লাগে 13°10′ × 4 মিনিট =52 মিনিট 40 সেকেন্ড। অর্থাৎ , কোনো স্থানে মুখ্য জোয়ার হলে সেখানে পরবর্তী মুখ্য জোয়ার হবে 24 ঘণ্টা 52 মিনিট 40 সেকেন্ড (প্রায়) পর।
তাই বলা যায় –

১) দুটি মুখ্য জোয়ারের মধ্যে সময়ের ব্যবধান প্রায় 24 ঘণ্টা 52 মিনিট 40 সেকেন্ড।
২) দুটি গৌণ জোয়ারের মধ্যে সময়ের ব্যবধান প্রায় 24 ঘণ্টা 52 মিনিট 40 সেকেন্ড।
৩) একটি মুখ্য জোয়ার ও একটি গৌণ জোয়ারের মধ্যে সময়ের ব্যবধান 12 ঘণ্টা 26 মিনিট 20 সেকেন্ড (প্রায়)।
৪) জোয়ার ও ভাটার মধ্যে সময়ের ব্যবধান 6 ঘণ্টা 13 মিনিট 10 সেকেন্ড (প্রায়)।

মন্তব্য করুন